কাবা শরিফ নির্মাণ ও সংস্কারের ইতিহাস

 


কাবাঘর মুসলিম উম্মাহর প্রাণকেন্দ্র। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র স্থান। যার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রোথিত রয়েছে প্রতিটি মুমিনের অন্তরে। কারণ কাবাঘরের দিকে মুখ করে গোটা মুসলিম উম্মাহ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। আবার প্রতিবছর বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হজব্রত পালনের উদ্দেশে কাবাঘর জিয়ারতে আসে মুসলিমরা। আল্লাহ তায়ালা কাবাকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা করেছেন এবং সে সঙ্গে তার আশপাশে কিছু স্থান ও বিষয়কে শাআইরিল্লাহ (আল্লাহর নিজস্ব পরিচয়-চিহ্ন) বলে নির্ধারণ করেছেন। ভৌগোলিকভাবে গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান, যা পৃথিবীর নাভি হিসেবে বিবেচিত।


পৃথিবীর প্রথম ঘর

হাদিসের ভাষ্য মতে, কাবার নিচের অংশ পৃথিবীর প্রথম জমিন। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির ২ হাজার বছর আগে সেখানে পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবা নির্মাণ করা হয়। আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ফেরেশতারা। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এই ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত এবং বিশ^বাসীর জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’ (সুরা আলে-ইমরান : ৯৬)


কাবাঘর নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ-সংস্কার

হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির ২ হাজার বছর আগে আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা এই ঘর নির্মাণ করেন। আদম (আ.) পৃথিবীতে আসার পর আল্লাহ তায়ালার হুকুমে পুনরায় কাবাগৃহ নির্মাণ করেন এবং কাবাকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির নির্দেশ পান। হজরত নূহ (আ.)-এর যুগে মহাপ্লাবনে এই ঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে হজরত ইসমাইল (আ.)। নির্মাণের পর আল্লাহ তায়ালা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে বিশ^বাসীকে এই ঘর জিয়ারতের আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও। তারা দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটে সওয়ার হয়ে তোমার কাছে আসবে।’ (সুরা হজ : ২৭)। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর আহ্বানের পর থেকে আজ পর্যন্ত কাবাকেন্দ্রিক ইবাদত ও জিয়ারত বন্ধ হয়নি। 


সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য মতে, কাবাকে এ পর্যন্ত ১২ বার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও শত্রুদের আক্রমণের কারণে বিভিন্ন সময় সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যারা এই মহান কাজে অংশগ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- হজরত আদম (আ.), হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও সহযোগী হিসেবে হজরত ইসমাইল (আ.), আমালিকা সম্প্রদায়, জুরহুম সম্প্রদায়, বিখ্যাত কুরাইশ বংশ যারা নবীজি (সা.)-এর বংশধর ছিলেন। নবুয়তপ্রাপ্তির ৫ বছর আগে এই পুনর্নির্মাণ করা হয়। এ কাজে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে মতভেদ দেখা দিলে সবার সম্মতিক্রমে নবীজি (সা.) কাবাগৃহে তা স্থাপন করেন। এরপর যথাক্রমে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এবং ওসমানিয়া খেলাফতের বাদশা মুরাদের নাম উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে কাবায় বিভিন্ন ইবাদত ও তাওয়াফ আরামদায়ক করার লক্ষ্যে আধুনিক ও উন্নত পাথরের ব্যবহারে কাবা চত্বরসহ বেশ কিছু উন্নয়নের কাজ করা হয়।


কাবাঘরের আয়তন

কাবাঘর বর্গাকৃতির। কাবাঘরের উচ্চতা ৪৫ ফুট। পূর্ব দেয়াল ৪৮ ফুট ৬ ইঞ্চি, পশ্চিম দেয়াল ৪৬ ফুট ৫ ইঞ্চি, উত্তর দেয়াল (হাতিমের পাশ) ৩৩ ফুট এবং দক্ষিণ দেওয়ালে (কালো পাথর কর্নার থেকে ইয়েমেনি কর্নার) ৩০ ফুট। কাবাঘরের দুটি দরজা ও একটি জানালা ছিল। বর্তমানে শুধু একটি দরজা রাখা হয়েছে। ভূমি থেকে ২.৫ মিটার (৪.২ ফুট) উচ্চতায় যার দৈর্ঘ্য ৩.৬ মিটার (১১.৮ ফুট) ও প্রস্থ ১.৬৮ মিটার (৫.৫ ফুট)। দরজাটি বাদশা খালিদ ২৮০ কেজি স্বর্ণ দ্বারা তৈরি করেন।


কাবাঘরের চাবি

মক্কা বিজয়ের পর নবীজি (সা.) কাবাঘরের চাবি বনি শায়বাহ গোত্রের ওসমান ইবনে তালহা (রা.)-এর কাছে হস্তান্তর করেন। বংশপরম্পরায় এখনও তারাই কাবাঘরের চাবির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বছরে দুবার এই ঘর খোলা হয় পরিষ্কার করার জন্য। একবার রমজান মাসে, অন্যবার ঈদুল আজহার ১৫ দিন আগে।


কাবাঘরের বৈশিষ্ট্য 

কাবাকেন্দ্রিক ইসলামের অনেক ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে। নামাজ, হজ, কোরবানি, পশু জবাই ও মৃত ব্যক্তির দাফনসহ অনেক ইবাদত আদায় করতে হয় কাবার দিকে ফিরে। হাদিসে এসেছে, হজরত আবু দারদা (রা.) ও হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত- নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মাসজিদুল হারামে (কাবা চত্বরে) নামাজ আদায় করলে এক রাকাতে ১ লাখ রাকাত নামাজের সওয়াব পাওয়া যায়।’ (সুনানে বায়হাকি: ১৮২১)। কাবা চত্বরে রয়েছে বরকতময় বহু নিদর্শন। মাকামে ইব্রাহিম, মুলতাজিম, হাজরে আসওয়াদ, মিজাবে রহমত, হাতিম, মাতাফ, রুকনে ইয়েমেনি; প্রত্যেকটি বরকতের আধার। এগুলোর কাছে গিয়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়। কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া। দোয়া কবুলের জন্য হাতিম উত্তম স্থান। হাতিমের ঠিক ওপরে কাবা শরিফে ঘরের ছাদের সঙ্গে একটি স্বর্ণের পরনালা আছে। বৃষ্টির সময় এই পরনালা দিয়ে ছাদের পানি পড়ে। সেজন্য এর নাম মিজাবে রহমত। মিজাবে রহমতের নিচে বসে দোয়া করলে কবুল হয়। বর্তমানে কাবাঘরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সৌদি রাজপরিবারের। সৌদি সরকারপ্রধান (বাদশাহ) কাবা শরিফের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করেন।


(সংগৃহীত)

Comments

Popular posts from this blog

Japan and atomic bomb.

Hazrat Omar (R)

Class eight : paraphrase